[Question] মোস্তফা চরিত গ্রন্থের রচয়িতা কে?
(ক) | মওলানা আকরম খাঁ |
(খ) | ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ |
(গ) | মোঃ বরকতুল্লাহ |
(ঘ) | মুহম্মদ আব্দুল হাই |
সংক্ষেপে ব্যাখ্যাঃ
মোস্তফা চরিত গ্রন্থের রচয়িতা হলেন মওলানা আকরম খাঁ ৷
কোন ধর্মের বিশেষত্ব ও সত্যতার সম্পূর্ণ উপলব্ধি করিতে হইলে, সেই ধর্মের প্রবর্তক যিনি, সর্বপ্রথমে তাঁহাকে সম্যরূপে চিনিয়া ও বুঝিয়া লইতে হয়। কতকগুলি বিশ্বাস, কতকগুলি অনুষ্ঠান এবং কতকগুলি বিষয়ের জ্ঞান- এই ত্রিধারার একত্র সামবেশ-ফলের নামই ‘ধর্ম’। আমরা মোছলেম এবং আমাদের ধর্মের নাম- এছলাম। এছলামের বিষয় সম্যরূপে অবগত হইতে হইলে- এছলামের সত্যতা ও বিশেষত্বে বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইলে, সর্বপ্রথমে হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (স)-এর চরিত্রের মাহাত্ম্য ও বৈশিষ্ট্যগুলিকে সম্যরূপে জ্ঞাত হইতে- অন্তত: জ্ঞাত হইবার চেষ্টা করিতে হইবে।
ঐতিহাসিক হিসাবে (ভক্তের হিসাবে নহে) জগতের সাধুসজ্জন ও মহাপুরষগণের জীবন ও চরিত্র আলোচনার চেষ্টা করিলে প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় যে, কিংবদন্তি- সঙ্কলক ঐতিহাসিক এবং অন্ধ ভক্তগণের দ্বারা তাঁহাদের প্রকৃত জীবন ও জীবনের আদর্শস্থানীয় আসল বিষয়গুলি হয়ত একেবারে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে, অথবা এমন পর্বত পরিমাণ কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের আবর্জনারাশির তলে তাহা চাপা পড়িয়া গিয়াছে- যাহার উদ্ধার একেবারে অসাধ্য না হইলেও সহজসাধ্যও নহে।
মানুষের দেহেরে ন্যায় তাহার আভ্যন্তরীণ প্রবৃত্তিগুলিও খুব বাবু। এই বাবুগিরির খাতিরে আমাদের জ্ঞান ও বিবেক, স্বাধীন আলোচনা ও গবেষণার দ্বারা, অসত্যের পুঞ্জীকৃত ন্যক্কারজনক আবর্জনারাশির নিম্ন হইতে সত্যের উদ্ধার সাধন করিবার জন্য, পরিশ্রম স্বীকার করিতে বড় একটা চাহে না। এই সহজিয়া মানসিকতা, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের গাড়ী-পাল্কীগুলিতে চড়িয়া পরম আনন্দে গা’ এলাইয়া শুইয়া পড়ে। ইহা মানবীয় দুর্বলতার সর্বাপেক্ষা মারাত্মক দিক। মহাপুরুষগণের জ্ঞানের গভীরতা, তাঁহাদের চরিত্রের মহিমা, তাঁহাদের জীবনের ব্রত ও সাধনা- এইসব লইয়া আলোচনা করিতে গেলে অনেক হাঙ্গামা উপস্থিত হয়।
পক্ষান্তরে মহাপুরুষকে ভক্তি করিতে হইলে, তাঁহার জীবনীকে একেবারে বাদ দিয়া গেলেও চলে না। তাই ভক্তগণ খুব সহজে উভয় কূল রক্ষা করিবার জন্য কতকগুলি আজগুবী, অনৈতিহাসিক, গল্প-গুজব এবং কতকগুলি অলৌকিক ও অস্বাভাবিক উপকথার আবিষ্কার করেন এবং সেইগুলির মধ্য দিয়া মহাপুরুষের নামের জয়জয়কার করিয়া মনে করিয়া লন যে, তাঁহাকে যথেষ্ট ভক্তি করা হইল। ক্রমে ঐসব কুসংস্কারমূলক উপকথা ও অলৌকিক কেচ্ছা-কাহিনী মহাপুরুষগণের জীবনের প্রকৃত শিক্ষণীয় বিষয়গুলিকে দূরে সরাইয়া দিয়া, ইতিহাস ও পুরাণ-পুস্তকসমূহের পৃষ্ঠায় স্থায়ীভাবে অধিকার জমাইয়া বসে।
কালক্রমে তাহাই ‘শাস্ত্র’ হইয়া দাঁড়ায় এবং সেইগুলি সম্বন্ধে সাধারণ সংস্কারের বিপরীত কেহ কোন কথা বলিতে চেষ্টা করিলে, তাহাকে শাস্ত্রদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী ও কাফের বলিয়া নির্ধারণ করা হয়। যুক্তির দিক দিয়া কোন কথা বলিয়া উদ্ধার পাইবার আশাও এই ক্ষেত্রে খুবই কম। আপনি ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রদান করিয়া, এমন কি মূল শাস্ত্রগ্রন্থের শত শত অকাট্য প্রমাণ উদ্ধৃত করিয়া দেখান, কিন্তু ‘ভক্তের’ নিকট সবই বিফল!
তিনি এক কথায় সকল যুক্তির উত্তর দিয়া বলিবেন- প্রাচীন মুনি-ঋষি ও শাস্ত্রকারগণ ‘ছলফে ছালেহীন ও বোজর্গানে-দীন’- কি এইসকল কথা বুঝিতেন না? তোমরা বাপু কি তাঁহাদের অপেক্ষা অধিক বিদ্বান হইয়াছ? বাপ-পিতামহ চৌদ্দপুরুষ যাহা বুঝিয়া ও বলিয়া গিয়াছেন তাহাকেই আঁকড়াইয়া জড়াইয়া ধরিতে হইবে, ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়: পরোধর্মো ভয়াবহ:।’ ইহাই হইতেছে মানুষের জ্ঞান ও বিবেকের অতি শোচনীয়তম অধ:পতন।
জগতের সমস্ত উন্নত ও প্রাচীন জাতির পতন ও মৃত্যু, মূলত: একমাত্র এই রোগেই সংঘটিত হইয়াছে। রোমান ও গ্রীকের মৃত্যু এবং ইহুদী ও হিন্দুর সর্বনাশ এই অন্ধবিশ্বাস, তাক্লিদ (গতানুগতি) ও স্থিতিস্থাপকতার জন্যই সংঘটিত হইয়াছে। খ্রীষ্টান যতদিন গির্জার বাহিরেও খ্রীষ্টান ধর্মের প্রভাব স্বীকার করিয়াছিল, ততদিন তাহার দুর্দশার ইয়ত্তা ছিল না। এখন সেই খ্রীষ্টান ধর্মের সমস্ত উপকথা ও আজগুবী অলৌকিকতাগুলিকে গির্জার গুদামঘরে পুরিয়া তালাচাবি বন্ধ করিয়া দিয়াছে। তাহার কর্মজীবনের সহিত ধর্মের আর কোনই সম্বন্ধ নাই।
জীবনে একবারও কোরআন শারীফের কোন একটি অধ্যায় পাঠ করিবার সৌভাগ্য যিনি লাভ করিয়াছেন, তাঁহাকে স্বীকার করিতেই হইবে যে, এই শ্রেণীর গতানুগতি ও অন্ধবিশ্বাসের মূলোচ্ছেদ করাকেই কোরআন নিজের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য বলিয়া নির্ধারিত করিয়াছে। কিন্তু হইলে কি হইবে- আজ মুছলমান নিজের জন্মগত ও পারিপার্শ্বিক কুসংস্কারের চাপে কোরআনের সেই স্পষ্ট শিক্ষাকে একেবারে ভুলিয়া বসিয়াছে- ভুলিয়া বসাকেই, এমন কি সেই শিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ করাকেই আজ তাহারা ‘এছলাম’ বলিয়া মনে-প্রাণে বিশ্বাস করিতে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। ফলে যেইসকল কারণে রোমান, গ্রীক, হিন্দু, ইহুদী প্রভৃতি প্রাচীনতম জাতিসমূহের সর্বনাশ হইয়াছিল, মুছলমানও আজ ঠিক সেই সব কারণের স্বাভাবিক অভিশাপে উৎসন্নে যাইতে বসিয়াছে।
নবী ও রছুল অর্থাৎ আল্লাহ্র নিকট হইতে প্রেরণা ও ভাববাণীপ্রাপ্ত মহামানুষগণ, মানবজাতির ইহ-পরকালের- ধর্মজীবনের ও কর্মসময়ের- স্বর্গীয় আদর্শ। জগতের প্রত্যেক যুগে ও প্রত্যেক দেশে আবির্ভূত এই নবী ও রছুলগণকে মুছলমানেরা ‘সৎ ও মহৎ’ বলিয়া মান্য করিয়া থাকেন- ধর্মত: তাঁহারা এইরূপ মান্য করিতে বাধ্য। তবে বিশেষত্ব এই যে, এছলাম তাঁহাদিগকে মাহামানুষ বলিয়া স্বীকার করিলেও, অতিমানুষের অস্তিত্ব এমন কি তাহার সম্ভবপরতাই স্বীকার করে না- বরং কঠোর ভাষায় তাহার প্রতিবাদই করিয়া থাকে। তাই আমরা দেখিতেছি, কোরআনে হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (স)কে সম্বোধন করিয়া পুনঃপুন: বলা হইতেছে- قل انما انا بشر مثلكم يرى الى الايه -বল, “আমি তোমাদেরই মত একজন মানব মাত্র- ইহার অতিরিক্ত আমি আর কিছুই নহি, তবে আমার নিকট আল্লাহ্র বাণী সমাগত হইয়া থাকে।”‘
মুছলমানদিগের ইহাও বিশ্বাস যে, হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (স) জগতের শেষ এবং শ্রেষ্ঠতম নবী। তিনি কোন দেশবিশেষের বা জাতিবিশেষের জন্য অথবা কোন নির্দিষ্ট যুগ বা সময়ের নিমিত্ত প্রেরিত হন নাই। বরং তিনি সকল জাতির’ সকল দেশের ও সকল যুগের সার্বভৌমিক, সার্বজনিক ও সার্বযৌগিকভাবে সমস্ত আ’লমের জন্য আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ দুনিয়ায় প্রেরিত হইয়াছেন।’ আর্য, ইহুদী, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সকলেই তাঁহার উম্মৎ এবং তিনি সকলেরই নবী অর্থাৎ সকলের জন্যই স্বর্গের সংবাদবাহক।
Also Read More:—