[Question] ইউসুফ জুলেখা গ্রন্থের রচয়িতা কে?
(ক) | মোবারক শাহ |
(খ) | ফররুখ আহমদ |
(গ) | শাহ মুহম্মদ সগীর |
(ঘ) | আল মাহমুদ |
সংক্ষেপে ব্যাখ্যাঃ
ইউসুফ জুলেখা গ্রন্থের রচয়িতা হলেন শাহ মুহম্মদ সগীর ৷
বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দান যে বর্তমান,-সে সম্বন্ধে কোন দ্বিমত নাই। তবে, এ-কথা সচরাচর বলা হয় যে, বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের পরোক্ষ দান অনেক পূর্ববর্তী এবং প্রত্যক্ষ দান বহু পরবর্তী সপ্তদশ শতাব্দীর ঘটনা। মুসলমানেরা খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী হইতে যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করিয়া আসিয়াছে, ইহা ঐতিহাসিক ব্যাপার হইলেও, সপ্তদশ শতাব্দীর অন্ততঃ দুই শতাব্দী পূর্ব হইতে বাংলা সাহিত্যে তাঁহাদের প্রত্যক্ষ দান যে বিদ্যমান ছিল, ইহাও বর্তমানে একটি ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হইয়াছে। শাহ মুহম্মদ সগীর নামক এক মুসলিম কবির ‘ইউসুফ জলিখা’ নামক একটি বাংলা কাব্যের আবিষ্কারেই এই ঐতিহাসিক সত্যটি প্রতিষ্ঠিত। এই কাব্যের রাজ-প্রশস্তি হইতে জানিতে পারা যায়, গৌড়ের সুলতান গিয়াসু-দ-দীন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৯৭-১৪১০খ্রী) কবি এই কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। সুতরাং হিউসুফ-জলিখা” খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দশকের কাব্য।
ইউসুফ – জলিখার প্রণয়-কাহিনী অতি প্রাচীন। বাইবেল ও কুরআনে ‘প্যারাবোল’ বা নৈতিক-উপাখ্যান হিসাবে এই কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণিত হইয়াছে। এই সংক্ষিপ্ত মূল- কাহিনীকে পল্লবিত করিয়া ইরানের মহাকবি ফিরদৌসী (মৃত ১০২৫ খ্রী:) ও সুফী কবি জামী (মৃত ১৪৯২ খ্রী:) তাঁহাদের ইউসুফ জলিখা’ নামক কাব্য দুইখানি রচনা করিয়াছিলেন। ফিরদৌসীর ” ইউসুফ-জলিখা” একটি রমন্যাস বা রোমাঞ্চ এবং জামীর “ইউসুফ জলিখা” একটি ‘এলিগরিক্যাল এপিক’ বা রূপক কাব্য। বিষয়বস্তু বা অনুবাদগত দিক হইতে সগীরের কাব্যের সহিত উক্ত কাব্যদ্বয়ের কোনটিরই হুবহু মিল নাই। তবে, সগীরের কাব্য ফিরদৌসীর কাব্যের ন্যায় রমন্যাস বটে। জামী তাঁহার পরবর্তী কবি; সুতরাং তাহার কথা উঠেই না। ইহা হইতে অনুমিত হয় যে, কুরআন ও ফিরদৌসীর কাব্য ব্যতীত মুসলিম-কিংবদন্তীতে ও স্বীয় সৃজনী প্রতিভায় নির্ভর করিয়াই শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁহার “ইউসুফ- জলিখা” কাব্য রচনা করিয়াছিলেন।
কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের জীবন-কথা জানা যায় না। কেননা, তাঁহার কাব্যে আত্মবিবরণী বলিতে সচরাচর যাহা বুঝাইয়া থাকে, তাহা তিনি লেখেন নাই। তবে, তাঁহার উপাধি দৃষ্টে অনুমান করা যাইতে পারে যে, তিনি ‘দরবেশ’-বংশে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার কাব্যের অধিকাংশ পাণ্ডুলিপি চট্টগ্রাম ও একটি খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি ত্রিপুরায় আবিষ্কৃত হওয়ায়, বিশেষতঃ তাঁহার কাব্যে ব্যবহৃত কতকগুলি বিশিষ্ট শব্দ আজও চট্টগ্রামী বাংলা উপভাষায় ব্যবহৃত হয় বলিয়া, অন্য প্রমাণের অভাবে ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে যে, তিনি চট্টগ্রাম জিলার অধিবাসী ছিলেন।
একমাত্র “ইউসুফ-জলিখা” ব্যতীত কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের অন্য কোন কাব্য কবিতা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। ইহাতে তিনি অন্য কোন কাব্য রচনা করেন নাই, এমন মনে করার কোন সঙ্গত কারণ নাই। আলোচ্য কাব্যখানি পাঠ করিলে দেখা যায়, ইহা বেশ পরিণত রচনা। তাঁহার ভাষা প্রাচীন বটে, তবে কাঁচা হাতের লেখা নহে। ইহা রচনার পূর্বে তিনি অন্য লেখায় হাত পাকাইয়া থাকিবেন।
কাব্যটিতে কোন বিদেশী আবহ নাই বলিলেও চলে। বাংলার পরিবেশ এই কাব্যের রক্তমাংস ও বাংলার আবহ ইহার প্রাণ বলিয়া কাব্যখানি পাঠ করিতে মনেই হয় না যে, ইহা কোন বিদেশীয় পুস্তকের অনুবাদ অথবা ভাবানুবাদ। তবে, তিনি কিতাব- কোরান দেখিয়া কাব্য রচনা করিয়াছেন বলিয়া প্রচার করিতেও কসুর করেন নাই। ইউসুফের সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা বনী য়ামীনের সহিত মধুপুরীর (ভাওয়ালের অন্তর্গত ‘মধুপুর’ কি?) গন্ধর্বরাজকন্যা বিধুপ্রভার বিবাহ-কাহিলী কোন কিতাব-কোরানে পাওয়া গিয়াছিল, বলিতে পারি না। এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া মনে হয়, কাব্যখানি মুসলিম কিংবদন্তী- নির্ভর রচনা।
ইউসুফ জুলেখা শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্য। কোরআনে বর্ণিত নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর কাহিনীকে বাইবেলেও এই কাহিনীর বর্ণনা আছে। কোরআন এবং বাইবেলের কাহিনী থেকে এর স্বাতন্ত্র্য প্রকটভাবে লক্ষণীয়। তা ছাড়া ইউসুফ-জুলেখার রচনায় যে বিনিয়ামিন এর কাহিনি আছে তা সম্পূর্ণই সগীরের মৌলিক রচনা। ডঃ এনামুল হক এ বইটি সম্পাদনা করতে গিয়ে কোরআনের তরজমা এবং বাইবেলের কাহিনী বর্ণনা করেছেন যা ঐশ্বরিক গ্রন্থ থেকে এ বইটির স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করতে সহায়তা করবে।
Also Read More:—