আনন্দমঠ উপন্যাসটি কাকে উৎসর্গ করা হয়? [MCQ]

5/5(3 votes)

[Question] আনন্দমঠ উপন্যাসটি কাকে উৎসর্গ করা হয়?

(ক)যতীন্দ্রমোহন বাগচী
(খ)দীনবন্ধু মিত্র
(গ)ভূদেব মুখোপাধ্যায়
(ঘ)রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে

উত্তরঃ (খ) দীনবন্ধু মিত্র


সংক্ষেপে ব্যাখ্যাঃ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম একটি উপন্যাস আনন্দমঠ উৎসর্গ করেন তার প্রয়াত বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রকে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত উপন্যাস আনন্দমঠ; শিল্পশৈলীর দিক থেকে যতটা নয়, তার চেয়েও বেশি প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর জন্যে।

জীবনান্তিকে বঙ্কিমচন্দ্র আত্মউদ্ভাবিত তত্ত্বের অনুসরণে যে-তিনটি উপন্যাস লিখেছিলেন, আনন্দমঠ তার একটি। অন্য দুটি উপন্যাস হচ্ছে দেবীচৌধুরাণী এবং সীতারাম। হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা ও অনুশীলনবাদ – এই তিনটি প্রসঙ্গকে অবলম্বন করে উপযুক্ত ত্রয়ী আখ্যায়িকার সৃষ্টি। উল্লিখিত বিষয়বস্তুর কারণে আনন্দমঠ-কে অনেকেই ‘রাজনৈতিক উপন্যাস’ এবং বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘জাতিস্রষ্টা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হিন্দু ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও স্বদেশ-জিজ্ঞাসার সূচনা হিসেবে উপন্যাসটির ঐতিহাসিক ভূমিকা প্রকাশের শতবর্ষ পরেও তাই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে থাকে। বঙ্কিমের এই ভাবনাসূত্রের মধ্যেই অবশ্য লুকিয়ে আছে আনন্দমঠকেন্দ্রিক বিতর্কবীজ। এ-প্রসঙ্গে প্রবেশের পূর্বে উপন্যাসটির প্রেক্ষণীপট ও কাহিনী সম্পর্কে আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে।

আনন্দমঠের কাহিনী চারটি খণ্ডে বিন্যস্ত। ঘন নিবিড় অরণ্য, মন্বন্তর, আর্থ-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং এসবের প্রেক্ষাপটে দেশচেতনায় উদ্দীপ্ত সন্তানদলের আবির্ভাব প্রথম খণ্ডের বিষয়বস্তু। দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে সন্তানদলের দীক্ষিত হবার বর্ণনা, তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, আত্মসংযম ও সংসারযাপনের চিত্র। তৃতীয় ও সর্বশেষ খণ্ডের বিষয় সন্তানদলের সঙ্গে ইংরেজের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে বিশাল রাজসৈন্য এমনভাবে ‘নিষ্পেষিত’ হল যে ‘ওয়ারেন হেস্টিংয়ের কাছে সংবাদ লইয়া যায়, এমন লোক রহিল না’। কিন্তু হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠা তখনও বঙ্কিমচন্দ্রের অভিপ্রায় ছিল না। মুসলমান শাসকের পরিবর্তে ‘ইংরেজ রাজ্যে অভিষিক্ত’ হবে বলে তিনি আনন্দমঠে ‘সন্তানবিদ্রোহ’ ঘটিয়েছেন।

লক্ষ করলে দেখা যাবে, আনন্দমঠের গল্পের বাঁধুনি বেশ শিথিল। পরিচিত গার্হস্থ্য জীবনের ছবি এতে অনুপস্থিত। নারী-পুরুষের চরিত্রগুলো একরৈখিক- ঔপন্যাসিকের নিজস্ব মতাদর্শের বাহকমাত্র; রক্তমাংসে গড়া নয়। এর ঘটনাবলিও ‘সুদূরে স্থাপিত’। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই জানিয়েছেন আনন্দমঠের কাহিনীর উৎস বাংলার সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, যা তিনি পেয়েছেন গ্লিগের Memoirs of the life of Warren Hastings এবং ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের Annals of Rural Bengal থেকে। উপন্যাসে বর্ণিত ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ভয়াবহ ছবিটিও হান্টারের উল্লিখিত গ্রন্থে পাওয়া যায়। এতসব ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষণীপটে আনন্দমঠ রচিত হলেও বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, সুতরাং ঐতিহাসিকতার ভান করি নাই।’

উপন্যাসটির বিষয়বস্তু লক্ষ করলে অবশ্য এর প্রতিপাদ্য সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। কোনো সন্দেহ নেই ইতিহাসভিত্তিক হলেও এটি একটি রাজনৈতিক আইডিয়াপ্রধান উপন্যাস। এই আইডিয়ার কেন্দ্রে রয়েছে ‘অকুণ্ঠ দেশপ্রেম’। হুমায়ুন কবির বলেছেন, এই উপন্যাসের আখ্যানবস্তু গড়ে উঠেছে উনিশ শতকের শেষার্ধে ভারতীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত জাতীয়তাবাদ (nationalism) ও দেশপ্রেমকে (patriotism) কেন্দ্র করে। তাঁর মতে আনন্দমঠের বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘ঐতিহাসিক কালাসঙ্গতি’ (historical anacronism), যা সমকালের বিকাশমান মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই মূর্ত করে তুলেছে। প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠের মাধ্যমে বাঙালিকে যে-দেশানুরাগ ও জাতীয়তার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বে সে-ধরনের কোনো জাতীয়তাবাদ ভারতীয় ইতিহাসে লক্ষ করা যায় না।

একে বলা যায় ‘দেশভক্তি’ বা ‘স্বদেশপ্রীতি’। আনন্দমঠে এই দেশচেতনারই তত্ত্বমূর্তি নির্মাণ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। এই দেশতত্ত্বের মূলকথা হল জাতি-অভিমান সৃষ্টি, প্রাণবিসর্জন বা আত্মত্যাগে ব্রতী হওয়া। সকল বাঙালিকে উল্লিখিত দেশব্রতে উদ্বুদ্ধ করে বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠে একটি অখণ্ড চেতনাসূত্র বা সমরূপতা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। আনন্দমঠে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের এই-যে ধারণা আমরা পাই, তা বঙ্কিমমানসেরই বিশিষ্ট প্রতিচ্ছবি, পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ নয়।

আনন্দমঠ উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের একাদশ পরিচ্ছেদে সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে মাতৃমূর্তির তিনটি রূপ দেখিয়েছে: মা যা ছিলেন, মা যা হইয়াছেন এবং মা যা হইবেন। দেবীমূর্তির এই ত্রিকালধর্মী ত্রয়ী পরিকল্পনা প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমিক বঙ্কিমের অতীতের জন্য গর্ব, বর্তমানের জন্য বেদনা ও ভবিষ্যতের জন্য আশার প্রতীক। এই আশা বাস্তবায়িত হওয়ার পথ হচ্ছে বিপ্লব সংগঠন, ইন্দ্রিয়জয়ী চরিত্র, বর্ণবৈষম্য লুপ্তি, ঐক্যবোধ ও শক্তিচর্চা। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বে এসব নিয়ে কেউ গভীরভাবে ভাবেননি। উনবিংশ শতাব্দীর দেশচেতনায় এই ভাবনা নতুন মাত্রা যোগ করে। উপনিবেশের অধীন ভারতবাসীকে তিনি দেশপ্রেমে ও স্বাধীনতা অর্জনের কঠিন ব্রতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যেই গীতার নিষ্কাম কর্মের আদর্শকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য বা মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল হিন্দু জাতি। এ কারণেই আনন্দমঠে তিনি মুসলমান-রাজত্বের অবসান ঘটিয়েছেন এবং সূচনা কল্পনা করেছেন ইংরেজ-শাসনের।

আরও পড়ুনঃ